আমাদের সেই কাঞ্চন
কাঞ্চন জানা, কাঞ্চন ঘর
কাঞ্চনজঙ্ঘা , কাঞ্চন মন ।’
অঞ্জনের হৃদয়গ্রাহী এই গানটি শুনতে শুনতে নির্ঘুম রাত কাটায়নি এমন বাঙালি তরুণ একসময় খুব কমই ছিল। শুধু অঞ্জন নয়, বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের কল্যানে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের কাছে এক অলীক বিষ্ময়। এসব গল্প কবিতা গানে কাঞ্চনজঙ্ঘার অলৌকিক সৌন্দর্য চিত্র আমাদের মননে একে দিয়েছে। সমরেশের ‘গর্ভধারিণী’ পড়তে পড়তে কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে আশ্রয় নেওয়া গ্রামগুলো দেখিয়েছে স্বপ্নের হাতছানি। ফেলুদা’র দার্জিলিং জমজমাট বা গ্যাংটকে গন্ডগোল কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে তৈরি করেছে অদ্ভুত রহস্যজাল, যা ভেদ করার জন্য সেই দূর্গমলোকে আমরা বারবার ছুটে যেতে চেয়েছি। এ যে কিসের আকর্ষণ, তা বোধ হয় কেবল স্রষ্টাই জানেন।
খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়, ভারত ভাগের আগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। তেঁতুলিয়া ছিল জলপাইগুড়ির একটি অবিচ্ছিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারও আগে শিল্প, বাণিজ্য ও নদী বন্দর হিসেবে তেঁতুলিয়া ছিল সুবিখ্যাত। মহানন্দা নদী দিয়ে আসা যাওয়া করত মহাজনী নৌকা, তেঁতুল তলায় বসত বাণিজ্য মেলা। এরপর ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের মহামারিতে উঠে যায় তার গৌরব। ইতিহাসের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া সেই সময়ে হিমালয় আর কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দূরের কিছু ছিল না। এ অঞ্চলে লোকেরা তখন অহরহ চলে যেতে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি পেড়িয়ে হিমালয়ের আরও কাছে।
এরপর দেশ ভাগ হলো। পাহাড় থেকে নেমে আসা মহানন্দা ভাগ করে দিল দুই ভূখন্ড। তুলে দিল এক অদৃশ্য দেয়াল। কিন্তু মানুষের তৈরি এই অবাস্তব দেয়াল কি আর হিমালয়কে আঁটকে রাখতে পারে। কার্তিকের ভোরে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারির কৃষকেরা যখন লাঙল কাঁধে মাঠে নামত সেই ব্রাক্ষ্ম মুহুর্তে উত্তরের প্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো থেকে উঁকি দিত সোনারাঙ্গা কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রকৃতির এই অপার্থিব মায়ার খেলা দেখে দেশ ভাগের পর জন্ম নেওয়া কোমলমতি শিশুদের মনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন জাগতো। তখন বুড়ো দাদা দাদিরা তাদের কোলে বসিয়ে শোনাত দূর দেশের সেই কল্পরাজ্যের গল্প, হিমালয় পর্বতমালা আর কাঞ্চনজঙ্ঘার গল্প।
কাঞ্চনজঙ্ঘা, পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত, যার উচ্চতা ৮৫৮৬ মিটার বা ২৮১৬৯ ফিট। এটি নেপালের পূর্ব সীমান্ত, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সিকিম রাজ্য সীমান্তের পূর্ব-হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত। গ্রেট হিমালায়ান রেঞ্জের পূব প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘা ম্যাসিফ একটি বিশাল যোগ চিহ্ন (+) আকারে বিস্তৃত যার বাহু উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমে প্রসারিত।
সিকিমের স্থানীয় লেপচা জনগোষ্ঠীদের পৌরাণিক কাহিনী ও ধর্মীয় রীতিতে এই পর্বতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। লেপচারা বিশ্বাস করে এই পর্বতেই পৃথিবীর প্রথম নর-নারী সৃষ্টি হয়েছে। আবার স্থানীয় লোপো জাতির বিশ্বাস, এই পর্বতে লুকিয়ে রাখা আছে বিপুল পরিমান ঐশ্বর্য।
হিমালয়ের পর্বতমালার অদ্ভুত সুন্দর এই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এক নজর দেখার জন্য আমাদের প্রত্যকের ভিতরের দূর্নিবার এক আকর্ষণ কাজ করে। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নয়, ধর্মীয় আকর্ষণও নয়; শুধুমাত্র এই পার্বত্যলোকের দূর্গম পথ পেড়িয়ে স্রষ্টার এই বিষ্ময়কর সৃষ্টির সৌন্দর্য অবলোকনের আশ্চর্য আনন্দ পাওয়াই উপলক্ষ্য। কেউ খুব কাছ থেকে তাকে দেখবে বলে বারবার ছুটে যান তারা তেঁতুলিয়া। সামর্থবানেরা পাড়ি দেন শৈলশহর দার্জিলিং। রাতের শেষ প্রহরে হিম ঠান্ডায় ঠকঠক কাঁপুনি সামলে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে টাইগারহিলে। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয় ম্যালে। কেউ কেউ তো পাড়ি দেয় আরও দূর্গম পথ। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে চলে যায় সান্দাকফু, ফালুট। মেঘের সাগরের মাঝ দিয়ে উঁকি দেয়া কাঁচা সোনা রঙের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে তারা বিমোহিত হয়, তৃপ্ত হয়। কেউ কেউ আধ্যাত্মিকভাবেই স্রষ্ট্রার কাছাকাছি চলে যায়। তবুও এই রুপসুধায় আঁশ মেটে, তারা বারবার ছুটে যান এক পলক দেখার নেশার।
কাঞ্চনজঙ্ঘার এই আকর্ষণ, এই আবেদন কখনো শেষ হবার নয়। এর অপার্থিব সৌন্দর্য ও বিশালতা আমাদের চেতনাকে তাড়িয়ে বেড়াবে সৃষ্টির শেষ পর্যন্ত।