বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ঝাল যেকোন রান্নায় আর কোনো উপাদান থাকুক আর না থাকুক, হলুদ থাকা চাইই চাই। শুধু কি ভারতীয় উপমহাদেশ? চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও হলুদের জয়জয়কার। কেবল রসনা বিলাসেই নয়, বিয়ের উৎসব থেকে শুরু করে রূপচর্চা এবং ঘরোয়া দাওয়াই হিসেবেও হলুদের উপস্থিতি ঘরে ঘরে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা যোগান দিতেও হলুদের সমকক্ষ বিকল্প নেই। ‘সুপারফুড’-এর তকমা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বেও দিন দিন কদর বাড়ছে হলুদের। প্রাকৃতিক রঙ হিসেবেও হলুদ অনন্য। জন্মসূত্রে ভারতীয় উপমহাদেশ ও পূর্বএশীয় এই মূল জাতীয় মসলাটি সাধারণত উষ্ণ ও বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে জন্মালেও ইদানীং শীতপ্রধান দেশগুলোও গ্রিনহাউজে হলুদ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু হলুদ চাষের জন্যে আদর্শ, তাই দেশের প্রতিটি কোণেই চাষ হয় বাঙালি রসুই ঘরের এই অত্যাবশ্যকীয় মসলাটির। তবে হলুদ চাষে কিছুটা দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয় বলে সমতলে দিন দিন কমছে হলুদের আবাদ। বাংলাদেশে উৎপাদিত হলুদ দেশের চাহিদা মেটাতে না পারায় প্রতিবছরই ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণের হলুদ। সমতলে যেখানে প্রতিনিয়ত কমে চলেছে হলুদ চাষের পরিমাণ, এর বিপরীতে আলোর পথ দেখাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম চাষিরা। প্রতিবছরই বাড়ছে হলুদের আবাদ। স্বাদে, গন্ধে, রঙে ও মানে সেরা হলুদের তকমা জিতে নিয়েছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির হলুদ। জুমের অন্যান্য ফসলের চেয়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রমে চাষাবাদ, ভালো ফলন, দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ও সহজে পরিবহনের সুবিধা থাকাই জুম চাষিরা ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন হলুদ চাষে।
যেখানে জুমে হেক্টরপ্রতি ধানের উৎপাদন গড়ে ১.২৭ টন, সেখানে হলুদ উৎপাদন হয় গড়ে ৬.৩৫ টন। নিবিড় পরিচর্যায় এমনকি ১১.৪ টন ফলনেরও নজির রয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের জমিগুলোতে। উন্নত জাতের হলুদ চাষ ও উন্নত চাষ পদ্ধতির প্রয়োগে ক্রমেই বাড়ছে হেক্টর প্রতি হলুদের উৎপাদন। সাধারণত পার্বত্য জনজাতিসমূহ জুম পদ্ধতির কৃষিতে অভ্যস্ত। জুমচাষে সাধারণত একটি জমিতে ৪-৫ মৌসুম আবাদের পর জমির উর্বরতা কমে এলে নতুন কোন বুনো জমিকে জুম চাষের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। পরিত্যক্ত জমিগুলোকে ১০-১২ বছরের জন্যে ফেলে রাখা হয় পূর্বের বুনো পরিবেশ সৃষ্টি হবার মাধ্যমে জমি পুনরায় উর্বর হয়ে উঠবার জন্যে। তবে অবৈধ লগিংয়ের ফলে বন উজাড় হয়ে যাওয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমিতে কাঠের বাগান তৈরি প্রভৃতি কারণে ক্রমেই সংকুচি হয়ে আসছে নতুন জুম সৃষ্টির সুযোগ। তাই ১০-১২ বছরের স্থলে ৩/৪ বছরেই জুম চাষিরা পুনরায় আবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন পরিত্যক্ত জুমে। অনুর্বর জমিতেই ফসল চাষে বাধ্য হতে হচ্ছে বলে ক্রমেই কমে আসছে জুমের বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন। এদিক থেকে ব্যতিক্রম হলুদ চাষ। একই জমিতে একটানা হলুদ চাষ করা যায় বলে নতুন জুম তৈরির প্রয়োজন যেমন ফুরিয়েছে, তেমনি জুমচাষিরাই রেহাই পাচ্ছেন অতিরিক্ত শ্রম ও অর্থ ব্যয়ের হাত থেকে। একই সাথে নতুন করে বন উজাড় করে জমি প্রস্তুতের প্রয়োজন কমায় রক্ষা পাচ্ছে এখনো টিকে থাকা বুনো পরিবেশ ও এর উপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্য।
বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চল হলুদ জাতীয় মসলা চাষের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে আরো একটি কারণে। জলাভূমি ও প্লাবনভূমির অংশটুকু ছাড়া প্রায় সমগ্র বাংলাদেশই তিন ফসলা জমির দেশ। এমন উর্বর ভূমির দেশে ৭-৯ মাস স্রেফ একটি ফসলের জন্যে রীতিমত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের সামিল। এদিক থেকে ব্যতিক্রম আমাদের পার্বত্য অঞ্চল। শ্রমিক স্বল্পতা, বর্ষায় চলাচলে ঝুঁকি প্রভৃতি কারণে পার্বত্য কৃষিতে ফসলের মৌসুম কেবল একটি। তাই কৌশলগত দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চলে হলুদ চাষের প্রসারে তা দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনে বিরূপ কোন প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে না। পার্বত্য অঞ্চলে হলুদ চাষের সম্ভাবনা নিয়ে তাত্বিক দিকসমূহ বিশ্লেষণ ছাড়াও বাস্তবতার নিরিখেও পার্বত্য কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে হলুদ।
মৌসুমি ফল চাষে পার্বত্য অঞ্চলে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিলেও বাস্তবে খুব একটা সুফল ভোগ করতে ব্যর্থ হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের কৃষক। অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারে পাইকারের স্বল্পতা, চাঁদাবাজি, পচনশীল ফল পরিবহণে উপযুক্ত কোল্ড চেইনের অভাব ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না উঠায় মৌসুমি ফলের বাম্পার ফলন হওয়া স্বত্ত্বেও তা কৃষকের মুখে হাসি ফোঁটাতে সক্ষম হয়নি। অপরদিকে হলুদ এমন এক ফসল যা জমি থেকে উত্তোলনের পর কেবল ধুয়ে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিলেই প্রক্রিয়াকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। শুকনো হলুদ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় বলে কোন নির্দিষ্ট সময়ে বাজারদর কম থাকলে চাইলেই তা ভালো দামের অপেক্ষায় সংরক্ষণ করা যায়। হলুদ পরিবহণেও নেই কোন ঝক্কি। গেলো কয়েক বছরের বাজারদর বিশ্লেষণে দেখা গেছে বাজারদরে উঠানামা করলেও হলুদে হতাশ হয়নি কৃষক। তাছাড়া সমতলে ক্রমেই কমছে হলুদের আবাদ, তাই সহসাই হলুদের দরে ধ্বস নামবে এমন সম্ভাবনা কম। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বে নতুন করে হলুদের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ছে হলুদের চাহিদা, ফলে আমদানি করা হলুদে নাকাল হবে কৃষক, এমন সম্ভাবনাও কম।
তাছাড়া কেবল স্থানীয় চাহিদাই নয়, রফতানির বাজারেও বাংলাদেশের হলুদের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের সমতল কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হরমোন এসবের প্রয়োগে উৎপাদিত ফসল রফতানির উপযুক্ত নয়। সেদিক আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের জমিসমূহ দূষন দোষ থেকে মুক্ত বিধায় পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত হলুদ আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয়ের উপযুক্ত। তবে পার্বত্য অঞ্চলেও রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিস্তার হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তাই হলুদ চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলের জমিগুলোকে রাসায়নিক দূষণ থেকে মুক্ত রাখার বিষয়টিও সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। কেবল কৃষিপণ্য হিসেবে নয়, হলুদ নির্ভর বিভিন্ন ফাংশনাল ফুড, আয়ুর্বেদিক দাওয়াই এবং রূপচর্চার উপাদান হিসেবে হলুদ প্রক্রিয়াজাত করার উদ্যোগ গ্রহণেও বৃদ্ধি পাবে হলুদের বাজার। সব দিক মিলিয়ে হলুদে আমূল বদলে যেতে পারে পার্বত্য অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি ও কৃষকের জীবনমান।
প্রচ্ছদ ছবি: মাহমুদ হাসান রাজিব