চাকুরী জীবনে ট্রেকিংয়ের গুরুত্ব
দৃশ্যটি খুব চেনা পরিচিত মনে হচ্ছে না?
বসের চোখ রাঙানির সামনে মনমরা হয়ে বসে থাকা বুট্টুস অথবা সহকর্মীর হতাশাজনক ওয়ার্ক পারফরম্যান্সে ত্যাক্ত বিরক্ত বস- আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত চরিত্রগুলোর সাথে নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। আমাদের দেশে কর্পোরেট সংস্কৃতি বলে আদৌ কিছু আছে কি নেই সেটা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু নয়টা পাঁচটার এই কর্পোরেট জীবনে সবাই প্রফুল্ল চিত্তে কাজ করতে পারছে না এই ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। আর কেউ যদি খুশি মনে কাজ করতে না পারে তাহলে প্রোডাক্টিভিটি তো কমবেই, পারফরম্যান্স খারাপ তো হবেই। ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে, মূলে গিয়ে কি আমরা সমস্যাটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি?
রাস্তার ধুলোবালি, হর্ণের বিকট শব্দ, মানুষের ধাক্কাধাক্কি আর অনন্ত জ্যাম ঠেলে সময়মত নয়টার অফিস ধরতে আমাদের বাসা থেকে বের হতে হয় কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে। এরপর সারাদিন চোখ নাক কান গুঁজে পড়ে থাকতে হয় ওয়ার্কলোড নিয়ে। পাঁচটায় অফিস শেষ হলেও আবারও সেই জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই রাত ৮ টা কিংবা ৯ টা। এরপর শুরু হয় সংসারের কর্তব্য, বাচ্চা কাচ্চা সামলানো, স্বামী-স্ত্রীর খিটিমিটি মিটিয়ে একরাশ ক্লান্তি ও বিরক্তি নিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়া।
ঘুম থেকে উঠে আবারো সেই একই রুটিন। এই একঘেয়ে জীবনে নেই পর্যাপ্ত বিনোদন, নিজস্ব শখ পূরণের পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ, না আছে সামাজিক নিরাপত্তা, না আছে দাম্পত্য সুখ। এমন জীবনে থাকে না কোন উৎসাহ উদ্দীপনা। কোন কাজেই মন বসে না। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরকে সাহায্য করে কোন একটা সমস্যার সমাধান করা হয়ে উঠে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রোডাক্টিভিটির গ্রাফ নিচে নেমে যায়। আর বস বেচারাই বা কি করবে, ‘রেজাল্ট’ বের করার জন্য তাকেও খ্যাচরম্যাচর করতে হয়। এতেও কাজ না হলে অপমানজনক কথাবার্তা বলে নেমে যাওয়া মোরালিটিকে আরো বেশি নামিয়ে দেয়। এভাবে জোর জবরদস্তি তো আর রেজাল্ট বের করা সম্ভব নয়।
প্রথম সারির কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক মডেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধিতে তাদের টিম স্ট্রেটেজি। আর তাই সহকর্মীদের মাঝে বোঝাপড়া তৈরির জন্য আজকাল তারা টিম বিল্ডিংয়ে নজর দিয়েছে। এই টিম বিল্ডিং ইভেন্টগুলো সচরাচর শহরের আশেপাশের রিসোর্টে দিনব্যাপি মোটিভেশনাল সেমিনার সিম্পোজিয়ামের ফাঁকে ফাঁকে একগাদা খাবার দাবার, ক্রিকে্ট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনের মত খেলাধুলার আয়োজন থাকে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বছরে একবার কক্সবাজার বা খুব বেশি হলে থাইল্যান্ড-মালয়শিয়াতে এমন একটি অ্যাক্টিভিটি আয়োজন করে থাকে। তাত্ত্বিকভাবে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডে টিম সিনার্জি দেখতে শুনতে খুবই কার্যকরী মনে হলেও বাস্তবতা হল এই ধরনের আউটিংগুলোতে এক্সিকিউটিভরা উৎসাহ পেলেও পারফরম্যান্সের চাপ থেকে সেখানে গিয়েও যেন স্বস্তি মেলে না। সত্যি বলতে এসব সভা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে লেকচার দিয়ে কখনোই কারও মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা।
দলের সবাইকে উজ্জীবিত রাখা, দলের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর চমৎকার একটি উপায় হতে পারে ট্রেকিং। কিভাবে?
ট্রেকিং সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কে কাজ করে। সম্পূর্ন অচেনা অজানা প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেকগুলো অনিশ্চিয়তাকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার পর নিজের মধ্যে যেই পরিতৃপ্তি ও আত্মবিশ্বাস চলে আসে এর তুলনা কোন কিছুর সাথে সম্ভব নয়। ট্রেইলে মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই শিখে যায় কিভাবে নিজের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে আপাত অসম্ভব গন্তব্যেও এক সময় পৌঁছে যাওয়া যায়।
পাহাড় এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষের সুপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বের হয়ে আসে। একটি ট্রেইলে একসাথে পথ চলতে চলতে একে অপরের সাথে ভালো বোঝাপড়া হয়ে যায়। একে অপরের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায় যা অফিসে বসে বছরের পর বছরও হয়ত জানা সম্ভব হত না। একটি ট্রেকে খুব সহজেই একজনের পারসোনালিটি বোঝা যায়। জানা যায় সবার শক্তির জায়গা আর দুর্বলতা কি কি, যা থেকে ওয়ার্কস্পেসের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য কারা সাহায্য করতে পারবে তা সহজেই বের করা যায়।
শহরের কোলাহোল, ধুলোবালি, অস্বাস্থ্যকর পানি, মাত্রাতিরিক্ত ভিড়, দূষণ থেকে দূরে পাহাড়ের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে স্বর্গীয় একটি পথ দিয়ে হেঁটে যাবার পর নিজেকে উদ্দীপ্ত আর পুনর্জীবিত মনে হবে। পাহাড়ের ঢালে কচি ঘাসে শুয়ে শুয়ে সূর্যাস্ত দেখার পর জীবন সম্পর্কে আপনার ধারনা পালটে যাবে। অদ্ভুত একটি মানসিক শান্তি দেহ ও মনে ছড়িয়ে পড়বে যা আমাদের প্রত্যেকের শুধু প্রফেশনাল জীবনে নয় আমাদের ব্যবক্তিগত জীবনের খুব দরকার।
পাহাড়ে ট্রেকিং কোন পূর্বনির্ধারিত মডিউল নয়। এতে প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিয়তা থাকে যার ব্যাপারে আগে থেকে কোনভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব না। তাই এর জন্য দলের সবাইকে মিলে পরিকল্পনা করতে হয়, কোন ট্রেইলে কার কি লাগবে এই বিষয়ে লজিস্টিক্সের সমাধান করতে হয়। ট্রেইলে কিভাবে কি হবে তা খুব ঠাণ্ডা মাথায় বসে কৌশল ঠিক করতে হয়। কাজগুলো দলের সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কেউ তখন ক্যাম্পের দেখভাল করে, কেউ আগুন জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করে, কেউ লাকড়ি কুড়িয়ে আনে আবার কেউ তরকারি কুটে দেয়- এভাবে দায়িত্ববোধ, তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া, বুঝেশুনে ঝুঁকি নেওয়া একে অপরের প্রতি বিশ্বাসের মত সবার সম্মিলিত কর্মের উপর দলের ট্রেকিং অভিজ্ঞতা কেমন হবে বা গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
আমাদের সবার কাছেই তো এখন হয়ত স্মার্টফোন আছে। কিছুদিন ব্যবহার করার পরে দেখবেন ফোনটি কেমন স্লো হয়ে গেছে। তখন আমাদের স্পিড আপ করার জন্য ফোনের র্যাম খালি করতে হয়। অপ্রয়োজনীয় ফাইলগুলো ফেলে দিতে হয়। ক্যাস ফাইলগুলো ডিলিট করে দিলেই ফোনের গতি আর কার্যকারিতা আবার বেড়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্কও ঠিক এমনই। কার্যকরী পারফরমেন্সের জন্য কিছুদিন পর পর এর রিবুটের দরকার হয়। সময় সময়ে রিচার্জ করতে হয়।
এখন তো বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করেও প্রমাণ করা গেছে যে কিছুদিন কাজ করার পর ছুটি নিয়ে সেই সময়টা প্রাকৃতিক পরিবেশে শারীরিক পরিশ্রম করে কাটালে আমাদের শরীরে এন্ডোরফিনস নামক হরমোন নির্গমন বৃদ্ধি পায়। এই হরমোন আমাদের মন ও মস্তিষ্ক খুশি রাখে যার ফলস্বরূপ মস্তিষ্কের সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
শুধু সৃষ্টিশীলতাই নয়, ট্রেকিংয়ের ফলে মানুষের মনযোগ, আত্মপ্রত্যয়, আত্মসম্মান, দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। ট্রেকিং আমাদের মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলে। যা আমাদের প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবার মূল কারণ। ট্রেকিং থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যেই শিক্ষাটি পাই, জীবনটা কোন প্রতিযোগিতা নয়। এখানে সবাইকে সাথে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোটাই একমাত্র সাফল্য।