
আমরা সবাই উন্নয়ন খুব ভালবাসি, তাই উন্নয়নের দোহাই দিয়েই লেখাটা শুরু করা যাক। এইতো কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ বেশ সাফল্যের সাথে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জন করেছে। এখন সামনে আছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি), যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা দেখে আমি নিশ্চিত খুব সহজেই আমরা এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোও পূরণ করতে সক্ষম হবো। তবে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দু-একটির সম্ভাব্য অর্জন নিয়ে আমি বেশ শঙ্কায় আছি। তার একটা হল ১৫নং লক্ষ্য, যা টেকসইভাবে অরণ্য ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ রোধ, ভূমি অবক্ষয় রোধ এবং জীববৈচিত্র্য ধংসরোধের ওপর জোর দেয়।
দ্বিধান্বিত চোখে আমি এই ১৫ নম্বর লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। বন নিয়ে আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গী, তাতে কী করে এই লক্ষ্য আমরা অর্জন করবো? আজ আন্তর্জাতিক বন দিবস। দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত আজ সকালের একটা খবরের ভেতর নজর দেয়া যাক।
চট্টগ্রাম জেলার একমাত্র প্রাকৃতিক ও সংরক্ষিত বন রামগড়-সীতাকুণ্ড বনভূমির মধ্য দিয়ে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। এতে ৬৩ হেক্টর বনভূমির বৃক্ষ কাটা পড়বে। ওই বনের মধ্যে রয়েছে দেশের প্রায় বিলুপ্ত হওয়া সবচেয়ে দীর্ঘতম বৃক্ষ। বন বিভাগ শুধু বৃক্ষসম্পদের যে আর্থিক মূল্য হিসাব করেছে, তার পরিমাণ ৭৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
…বন বিভাগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সংরক্ষিত বনের মধ্যে এই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা বনের বাইরে দিয়ে এই লাইন নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ওই সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কারণে যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়বে, তার চেয়ে বেশি গাছ তারা অন্যত্র রোপণ করবে।
কাণ্ডখানা দেখুন। বনের গাছ কাটা পড়ার ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব জঙ্গলের বাইরে অন্য কোথাও গাছ লাগিয়ে দেবার কথা বলছেন। অর্থাৎ পরিষ্কারভাবেই, বন বলতে তিনি শুধু গাছই বোঝেন, সেটাকে তিনি জানা অজানা অজস্র প্রাণী-পাখি-পতঙ্গের বাসস্থান হিসাবে দেখেন না। দ্বিতীয়ত, বনবিভাগও সম্ভাব্য ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে আর্থিক মূল্যই হিসাব করেছে। এমনকি বন বিভাগের কাছেও বন মানেই গাছ, গাছ মানেই টাকা। অবশ্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে নিয়োজিত কমিটির এ ধরনের বনের ক্ষতির যথার্থ হিসাব করার মতো কোন পদ্ধতি এখনো দেশে নেই বলেও তাদের প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে।
কিন্তু কেন নেই? উত্তর হল, থাকবেই বা কী করে? বনকে আমরা সবসময়ই আর্থিক দৃষ্টিকোন থেকেই দেখেছি, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসাবে নয়। উল্লিখিত নিরূপণ কমিটিতে যেসব সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন, সেসবের একটি হল বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি)। এটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এই করপোরেশনের কাজই হল বনকে টাকায় রূপান্তর করা। বিশ্বাস না হলে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো দেখুন:
[১] দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে বনজ সম্পদ যান্ত্রিক উপায়ে আহরণ।
[২] কাঠ ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
[৩] কাঠের টেকসই, সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
[৪] রাবার বাগান সৃজন।
[৫] কাঁচা রাবার উৎপাদন ও বিপণন।
[৬] কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচন।
[৭] জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন ও জাতীয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা।
পাকিস্তান আমল থেকেই এই করপোরেশনটি প্রাকৃতিক বন ধ্বংসে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বন বিভাগের সাথে এই ধরণের কর্মকাণ্ড কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না? উত্তর হল, সামান্যই। উপরের প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘…রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোন সরকারি সংস্থা উন্নয়ন কাজের জন্য বনের জমি চাইলে আমরা প্রচলিত নিয়ম মেনে সহযোগিতা করে থাকি।’ কোন সন্দেহ নেই কেন এই নদী বিধৌত অতিশয় উর্বর ব-দ্বীপে মাত্র ১১.২ শতাংশ বনভূমি, যার আবার ৩০ শতাংশই প্ল্যান্টেশন বা বৃক্ষ রোপণ করে বনায়ন। অথচ পাশের পার্বত্য দেশ ভুটানের ৮১.৫ শতাংশ এবং বেশ কয়েকটি মরুভূমির (গরম ও ঠাণ্ডা) মালিক ভারতের ২৪.১ শতাংশ ভূমি অরণ্যময়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, প্রায় ৮২ শতাংশ বনভূমির দেশ ভুটান নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং সারাদেশের মানুষের পাশাপাশি ভারতও তার সুফল ভোগ করে। কয়েকমাস আগে ভুটান গিয়ে দেখেছি, তাদের বিদ্যুৎ গ্রিড টানা হয়েছে বনভূমি ধ্বংস না করেই, গাছের বেশ ওপর দিয়ে। আমরাও সেটা করতে পারি। ব্যাপারটা অভিনব কিছু নয়। আমাদের দেশেও এমন সুউচ্চ টাওয়ার স্থাপন করে বড় নদীগুলোর ওপর দিয়ে ন্যাশনাল গ্রিড টানা হয়েছে। সমস্যা হল রেলের লাইন, সড়ক, গ্যাসের লাইন, বিদ্যুৎ লাইন যেকোন কিছু স্থাপন করার প্রয়োজন পড়লেই আমরা দ্বিতীয়বার না ভেবেই নির্বিচারে বন কেটে ফেলি। এক লাউয়াছড়ার ভেতরেই আপনি উপরের সবগুলো দেখতে পাবেন। জানলে অবাক হবেন, লাউয়াছড়ায় গেট দিয়ে ঢুকতেই যে প্রধান ট্যুরিস্ট ট্রেইলটি আছে, যেটি রেললাইনের ওপর দিয়ে গেছে, সেটি মূলত একটি গ্যাসের পাইপলাইন, যা ইউনোকল স্থাপন করেছিল।
অদ্রিতে বন নিয়ে লিখতে শুরু করার কারণ হল, পাহাড়ের সাথে অরণ্যের গল্প মিলেমিশে আছে। অরণ্য ধ্বংসের গল্প বললেই বোধ হয় যথার্থ হবে। এই অঞ্চল ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভারসিটি হটস্পটের অংশ। অথচ বনের নিজস্ব ইকো সিস্টেমের কথা মাথায় না রেখে স্থানীয় প্রজাতির গাছ কেটে সেগুন এবং ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়েছে এক সময়। এখন এই দুটি প্রজাতির গাছ লাগানো বন্ধ হলেও চালু আছে একাশিয়া, আগর আর রাবার প্ল্যান্টেশন। এই প্ল্যান্টেশনের জন্য প্রথমেই যা করতে হয়, তা হল জঙ্গলের ক্লিয়ার-ফেলিং, মানে কেটে সাফ করে ফেলা। এই ধরণের ‘উন্নয়ন’ বেশ কয়েক ধরণের অবনয়নের কারণ হয়। বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাস সংকুচিত হওয়ায় প্রথমত তাদের নিজেদের মধ্যে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা ও খাদ্যের অভাব বাড়ে, দ্বিতীয়ত তারা নিজেরাই শিকারি মানুষের সহজ শিকারে পরিণত হয়। আবার, প্ল্যান্টেশনের আগ্রাসনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলো বনের আরও ভেতরে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় জুমচাষের কারণে আরও নতুন বন ধ্বংস হয়।
২০১৩ সালে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়িতে গিয়ে রাবার প্ল্যান্টেশনের রমরমা অবস্থা দেখে এসেছিলাম। মাইলের পর মাইল সবুজ দেখে পর্যটকের চোখ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু অভিজ্ঞ কান আর হৃদয় ব্যাথায় আচ্ছন্ন হয়, কারণ সেখানে একটা পাখিও ডাকে না। পুরো এলাকাই একটা সবুজ রঙের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাইশেরী ইউনিয়নে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা বাদুর ঝিরি নামে ‘চাক’ জনগোষ্ঠীর একটি গ্রামকে উচ্ছেদ করার পর সেখানে গিয়েছিলাম। অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, মূলত রাবার ও অন্যান্য মনোকালচার বা একই প্রজাতির আর্থিকভাবে লাভজনক উদ্ভিদ লাগানোর জন্য জায়গা-জমি দখল করাই ছিল চাকদের উচ্ছেদের কারণ। ধ্বংসপ্রাপ্ত বনকে পতিত জমি দেখিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে পাহাড় লিজ নেয় বাঙালিরা।
এই জীববৈচিত্র্যের আবাস ধ্বংসের আয়োজন থামার কোন লক্ষণ দেখছি না। ইদানিং থানচির সীমানা ঘেঁষে আলিকদমে প্রাচীন অরণ্য ধ্বংসের যে মহোৎসব দেখে এলাম তা একটা হাহাকার তৈরি করলো বুকের ভেতরে। কির্স তংয়ের নামে পরিচিত এই বন আনক্লাসিফাইড স্টেইট ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত, যা রিজার্ভ বা প্রোটেক্টেড নয়। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে কেওক্রাডং এলাকায় বুলডোজারের চেইনের দাগ দেখে চমকে উঠেছিলাম, দ্বিতীয় দশকে এই কির্সতং অঞ্চলে। কাঠ ব্যবসায়ীরা গাছ কাটার জন্য নিজেরাই রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলাফল আদি ও অপরিবর্তিত; বন থেকে শুরু করে সাঙ্গু নদী পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সারি সারি সুন্দর করে সাইজ করা কাঠের স্তূপ। আমার কাছে মনে হয় বন্যপ্রাণীর কফিন। এই বনে এখনও বিড়াল প্রজাতির প্রাণী (মানে ছোটখাটো বাঘ), ভালুক, হরিণ, সজারু এবং রাজ ধণেশসহ বিভিন্ন দুর্লভ পাখির আবাস। এমন প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি বনকে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিয়ে কি করে কাঠ ব্যবসায়ীদের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া যায় তা আমার পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। উন্নয়নবিদরা ভাল জানবেন। তবে উন্নয়নবিদরা এসডিজির ১৫ নম্বর লক্ষ্যটি কিভাবে অর্জন করার পরিকল্পনা করছেন সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে আমার।
‘পাহাড় যারা ভালবাসেন,
বারবার পাহাড়ে ছুটে যান এর রূপ-রস-রং উপভোগ করতে,
আমার মনে হয় দায়িত্ব তাদেরই বেশি।’
এই বনটিকে দ্রুতই সংরক্ষিত বন কিংবা ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা করে গাছ কাটা বন্ধ করে দেওয়া আবশ্যক। আশপাশের মুরং জনগোষ্ঠীর মানুষকেও শিকারে নিরুৎসাহিত করে আমিষের বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া দরকার। চারপাশে জুমচাষ ও লগিংয়ের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কির্স তংয়ের প্রায় বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে সাঙ্গু-মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্ট। কির্স তং থেকে সেই পর্যন্ত একটা ইকোলজিক্যাল করিডোর বানানো গেলেও চমৎকার হয়। এর জন্য বেশি কিছু করতে হবে না। পাহাড় শ্রেণিটির চূড়া ধরে কয়েকশ মিটার চওড়া করে গাছ কাটা ও জুম চাষ বন্ধ করে দিলে নিজে থেকেই জঙ্গল হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটাকে গতি দিতে স্থানীয় কিছু গাছের চারা রোপন করা যেতে পারে বড়জোর। এটা করা গেলে আটকে পড়া বন্য প্রাণীরা বিস্তৃত এলাকায় চলাচলের মাধ্যমে উপযু্ক্ত আবাসস্থল খুঁজে নিতে পারবে। ভুটান এধরণের ইকোলজিক্যাল করিডোর বানিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের বনভূমিকে সংযুক্ত করে সুফল পেয়েছে।
এই কাজগুলো নিজে থেকেই হবে না, এক্ষেত্রে সরকারের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। পাহাড় যারা ভালবাসেন, বারবার পাহাড়ে ছুটে যান এর রূপ-রস-রং উপভোগ করতে, আমার মনে হয় দায়িত্ব তাদেরই বেশি। কির্স তং-রুংরাংয়ের বিপদের খবর ট্রেকারারই প্রচার করেছেন এবং করে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকিটুকুও করতে হবে, করে যেতে হবে, বনটাকে রক্ষা করার আগ পর্যন্ত। আমি মাঝে মাঝে খুবই বিরক্ত হই যখন কোন তরুণ ট্রেকার বলেন, ‘চেষ্টা করে কোন লাভ নেই’ বা ‘হবে না, কিচ্ছু হবে না।’ আমার মনে হয় মানুষের কাজ চেষ্টা করা; ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করা না। পাহাড়ের ট্রেইলে ট্রেকারদের পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল এবং একরোখা হতে হয়। এই তিনটি গুণ বছরে কয়েকবার সপ্তাহান্তের পাহাড় যাপনেই সীমাবদ্ধ না থেকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন যাপনেও কাজে আসুক।
সবাইকে আন্তর্জাতিক অরণ্য দিবসের শুভেচ্ছা। অরণ্য জীবনময় হোক, আপনার জীবনও অরণ্যময় হোক।
দারুন লেখা !
বনবিভাগও সম্ভাব্য ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে আর্থিক মূল্যই হিসাব করেছে। এমনকি বন বিভাগের কাছেও বন মানেই গাছ, গাছ মানেই টাকা।
Things to think …